চীনের মহাপ্রাচীর। মানুষের হাতে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থাপত্যশিল্প। পৃথিবীর সপ্তাশ্চার্যগুলোর একটি। দীর্ঘতম এই প্রাচীরটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৮৮৫১.৮ কিলোমিটার। কথিত আছে, এর উপর দিয়ে একসঙ্গে ১২ জোড়া ঘোড়া চলতে পারত। এটি চীনের সাংহাই পাসে শুরু হয়ে শেষ হয় লোপনুরে। খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৭৩ সালে সিমাটাই অঞ্চলে এর মূল অংশের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল।

 

চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াঙের অধীনে নির্মিত প্রাচীরটি সবচেয়ে বিখ্যাত। তবে বর্তমান প্রাচীরটি মিং রাজবংশের শাসনামলে নির্মিত হয়। প্রাচীরটি চীনের ১৫টি প্রদেশ, কেন্দ্রীয় সরকারের ৯৭টি প্রশাসনিক অঞ্চল এবং ৪০৪টি ছোট ছোট শহরের মধ্য দিয়ে ঘুরেছে। দীর্ঘ এই প্রাচীর ঘিরে পর্যটকদের উৎসাহের শেষ নেই। প্রতি ইঞ্চিতেই যেন বিস্ময়। এর মধ্যেও সবচেয়ে সুন্দর-আকর্ষণীয় ৬টি স্থান বিশ্বভ্রমণ পিপাসুদের তালিকায় শীর্ষস্থান করে নিয়েছে। সিএনএন।

ইয়ংতাই টার্টল সিটি
গ্রেট ওয়াল কেবল একটি ইট ও পাথরের প্রাচীর নয়। পাশের উচু উচু পাহাড়ের চূড়া, দুর্গ দিয়ে সাজানো বিভিন্ন শহর সহ স্রোতের টানে বয়ে চলা নদীগুলোকেও এর অংশ হিসাবে গণনা করা হয়। ইয়োলো রিভার (হলুদ নদী) ডিফেন্স লাইনের অংশ হিসাবে মিং রাজবংশের (১৩৬৮-১৬৪৪) নির্মিত টার্টল সিটির কাজ ১৬০৮ সালে সম্পন্ন হয়েছিল। যেখানে প্রায় ২,০০০ মানুষ এবং ৫০০ অশ্বারোহী ইউনিট ছিল।

বর্তমানে এই দুর্গ শহরটি চীনের উত্তরের কেন্দ্রীয় গানসু প্রদেশের জিংতাই এর সিতান শহরে অবস্থিত। জিংতাই থেকে মাত্র ৩০ মিনিটের দূরত্বে। টার্টল সিটি তে অনেকগুলো আসল কচ্ছপ না থাকলেও এটি অনন্য আকৃতির কারণে তার এই ডাকনাম পেয়েছে। এর দক্ষিণ গেট শহরটির প্রবেশদ্বার। ডিম্বাকৃতি প্রাচীর হল শহরটির দেওয়াল। আর উত্তর গেটটি শেষ অংশ। বর্তমানে চীনের সবচেয়ে সংরক্ষিত এবং প্রাচীরযুক্ত শহরগুলোর মধ্যে এটি একটি।

মুতিয়ানু এবং জিয়ানকু
মুতিয়ানু এবং জিয়ানকু মহাপ্রাচীরটির দুটি সংলগ্ন অংশ। বেইজিংয়ের থেকে পাহাড়ের চূড়া বরাবর প্রায় ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রসারিত। ৯০ মিনিটেরও কম সময়ে এখানে যাওয়া যায়। ইতিহাস থেকে জানা যায় লাখ লাখ শ্রমিক এই অংশটুকু নির্মাণে প্রায় শতাব্দী ব্যয় করেছে। এর একবারে চূড়ায় দাড়ালে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনুভব করা যায়।

মুতিয়ানু ও জিয়ানকুও মিং রাজবংশের টিকে থাকার দুটি বড় অস্ত্র হিসাবে কাজ করেছে। এর যে কোনোটিতে আরোহণ করা ভ্রমণপিয়াসীদের জীবনের অন্যতম এক অভিজ্ঞতা দেয়। মুতিয়ান পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে প্রাচীরের সেরা অংশ। অসাধারণ সুন্দর এ অংশের একেবারে শীর্ষে যেতে পারেন দর্শনার্থীরা। জিয়ানকু অংশটুকু বন্য প্রাচীর নামেও পরিচিত। এখানে যেতে কোনো টিকিটের প্রয়োজন নেই। কারণ এটি এখনো বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়নি। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে ২০২০ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকার এখানে হাইকিং নিষিদ্ধ করেছে।

বাতাইজি
বাতাইজি গ্রামটি মহাপ্রাচীরের মতিয়ানলিং শহরের ঠিক ভেতরে অবস্থিত। ১৮৭৬ সালে নির্মিত একটি গির্জার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। একজন জার্মান ধর্মপ্রচারকের নির্দেশে নির্মিত হয়েছিল। ১৫০ বছরের ইতিহাসে বহুবার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বর্তমানে এটিকে মেরামত করা হয়েছে। গির্জার বেল টাওয়ারটিই একমাত্র অংশ, যা এখনো বিদ্যমান। সুন্দর একটি সকাল বা বিকাল কাটানোর জন্য বাতাইজি একটি অনন্য জায়গা। গ্রামটি দেখার জন্য একটি আদর্শ সময় হলো গ্রীষ্মের শেষের দিক। কারণ এ সময় প্রাচীর ও এর পাশের সবুজ পাহাড়ের মধ্যে এক বিস্ময়কর বৈসাদৃশ্য দেখা যায়।

লাওনিউওয়ান
লাওনিউওয়ানের আরেক নাম ওল্ড অক্স বেন্ড গ্রেট ওয়াল। স্থানীয়রা মনে করে, লাওনিউওয়ান এমন একটি গ্রাম যেখানে প্রাচীর এবং শক্তিশালী হলুদ নদী এক সঙ্গে হাত মেলায়। এটি ১৪৬৭ সালে নির্মিত হয়েছিল। যখন এই এলাকার গ্রেট ওয়ালের সবচেয়ে বিখ্যাত টাওয়ার ওয়াংহে (আক্ষরিক অর্থে নদী দেখার টাওয়ার) অবস্থিত। ১৫৪৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। লাওনিউওয়ান গ্রামটি শানসি প্রদেশের শিনঝো শহরের পিয়াওইয়াং এলাকায় অবস্থিত। গ্রীষ্মের শেষের দিক বা শরতের শুরুতে এটি ভ্রমণ করার জন্য একটি উপযুক্ত সময়। গ্রেট ওয়াল বরাবর মাত্র কয়েকটি জায়গা রয়েছে যেখানে এটি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। তার মধ্যে লাওনিউওয়ান সবেচেয়ে আশ্চর্যজনক।

পরি টাওয়ার
সিমাতাই (যেখানে গ্রেটওয়াল নির্মাণ শুরু হয়েছিল) অংশের সবচেয়ে পরিচিত টাওয়ারগুলোর একটি হলো পরি টাওয়ার। কিন্তু এখানে প্রবেশ করা কঠিন বলে খুব বেশি পর্যটক এখানে আসেন না। এর পরিবর্তে ওয়াংজিং টাওয়ার (পরি টাওয়ার থেকে মাত্র কয়েকশ কিলোমিটার দূরে) থেকে পরি টাওয়ারের অবিশ্বাস্য সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা যায়। মুতিয়ানু এবং জিয়ানকুর মতো প্রাচীরের এই অংশটি বছরের যে কোনো সময় অনাবিল সৌন্দর্য অবলোকনের নিশ্চয়তা দেয়।

দুশিকৌ
সম্রাট জিয়াজিংয়ের (১৫০৭-৬৭) শাসনামলে নির্মিত প্রাচীরের এই একক অংশটি কিছু জায়গায় সাত মিটার পর্যন্ত লম্বা পাথরের স্তূপ দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। চীনের হুবেই প্রদেশের চিচেংয়ের দুশিকৌ শহরের রাস্তার ঠিক পাশে অবস্থিত। দুশিকৌর স্তূপ পাথরের দেওয়ালটি অনন্য একটি স্থান। কারণ বেইজিংয়ের কাছে গ্রেট ওয়ালের অন্যান্য অংশগুলো ভাটাচালিত ইট ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছিল। এটি সবচেয়ে সুন্দর থাকে গ্রীষ্মে বিশেষ করে জুলাই এবং আগস্টে। যখন আশপাশের গোলাকার পাহাড়গুলো ঘন সবুজ হয়ে যায়। এই সময়ের শীতল সন্ধ্যা আউটডোর, বারবিকিউ বা বনফায়ারের উপযুক্ত আবহাওয়া বিরাজ করে।